কারেন্ট চলে গেছে। উঠানে সবাই বসে আছে—দাদু, বাবা আর আমি। বাতাসে ভেসে আসে তালপাতার খসখস আর দূরে কোথাও মশার কয়েলের গন্ধ। কেরোসিন বাতির নিচে দাদুর মুখটা গভীর ছায়ায় ঘেরা, চোখে হাজার বছরের ক্লান্তি।
হঠাৎ তিনি বললেন,
“তোর বাপ দেখছে যুদ্ধের লাশ, আমি দেখছি ক্ষুধার লাশ।
১৯৪৩ সালের মন্বন্তর—সেইটা এক নীরব মহাযুদ্ধ, শুধু গুলি নাই, বোমা নাই।
তবু লাশ পড়ছিল হাজারে হাজারে।”
আমি থমকে যাই। দাদুর গলা যেন ভিতর থেকে উঠে আসা জ্বালায় কাঁপে।
“ব্রিটিশরা চাল লইয়া গেল যুদ্ধের খাতিরে।
মুসলিম লীগ মজুতদাররা গুদাম ভইরা রাখল, বাজারে কিচ্ছু নাই।
ঘরে পেট পুরা মানুষ, কিন্তু হাঁড়িতে জল।
মায়ের চোখে দেখছি কান্না লুকায়া রাখা।
রাস্তার পাশে মরা মানুষরে খাইত কুকুর, চোখ উপড়াইত শকুন।
তখন পদ্মা নদী ছিল খালি পেটের নদী—
মাছও ক্ষুধায় দুর্বল, আমরাও।
জাল ফেলতাম, কিচ্ছু উঠতো না।
একই নদী, এক শরীর—মানুষ আর মাছের দুর্ভিক্ষ ছিল একসাথে।”
বাবা সিগারেট ধরিয়ে শুনছিল। এবার ধোঁয়ার ফাঁকে হেসে বলল,
“তুমি ক্ষুধার নদী দেখছো, আমি দেখছি মৃত্যুতে পূর্ণ নদী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পদ্মা ছিল লাশের ডোবা।
দিনে মিলিটারিরা চোখ বাঁধা মানুষরে লাইন ধইরা গুলি কইরা নদীতে ফালাইত।
রাতে রাজাকার আসতো—চুপিচুপি জবাই দিত।
অনেকে জীবিত, পায়ে কলসি বাইন্ধা ফালাই দিত।
আমরা বাঁশ রাখতাম ঘাটে, যেন লাশ ভাসে এলেই ঠেলতে পারি মাঝ নদীতে।
তখন মানুষ ঘাটে আসতো আপনজন খুঁজতে—
‘একটা ছেলে—লম্বা, গায়ের রঙ ফর্সা, বাবরি চুল’—ভাসতেছে কী?’
‘মাইয়া ছিল, মাথায় লাল ফিতা—দেখছেন?’
আমরা কী কইতাম তখন?”
আমি কিছু বলি না, শুধু দাদু আর বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
সেই চোখে পদ্মার জল না, যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের শরীর জমে আছে।
বাবা আবার বলে,
“নদীতে মাছ ধরার সাহস ছিল না।
জাল ফেললে মাছ না, লাশ উঠে।
পচা গন্ধে জাল ধইরা রাখা যায় না।
তবু যুদ্ধের পরে—যখন মানুষ ক্ষুধায় পইড়া জাল ফেলল—
তখন পদ্মা ফিরায়া দিল একরাশ ইলিশ।
২ কেজি, ৩ কেজির চকচকে ইলিশ।
পিঠের লাল মাংস, যেন হরিণের।
কিন্তু খাইতে গেলে মনে হইত—
এইডা মানুষের মাংস।
মাছ খাইতেছি না, যেন সেই লাশগুলাই আরেক রূপে ফিরে আসছে।
ইলিশ তো ঘাস-পাতা খায়,
কিন্তু এই ইলিশ শিখে গেছিল পঁচা মাংস খাওয়া।
মাছ বড় হইসে মানুষের শরীর খাইয়া।”
দাদু চুপ করে শুনছিলেন, এবার চোখ মেললেন ধীরে ধীরে।
“তোমাদের পদ্মা লাশ খাইছে, আমাদের পদ্মা খাইছে আত্মা।
এক নদী—দুই সময়—দুইটা রকমের মৃত্যু।
কিন্তু দুইটারই গন্ধ ছিল এক, দুইটারই জলে ছিল নীরব কান্না।”
বাতাস থেমে গেছে মনে হয়।
তাল গাছও স্তব্ধ।
আমি মনে মনে ভাবি—
এই নদী শুধু পানি নয়,
এই নদী আমাদের ইতিহাস,
আমাদের শরীরের ভেতরে গচ্ছিত এক বেদনার রেখা।
বাবা ধীরে বলে ওঠে—
“তবুও, যুদ্ধের পরে, সংগ্রামের পরে
নদী আমাদের ফিরায়া দিছিল কিছু।
ফিরায়া দিছিল সেই ভয়ংকর সুন্দর ইলিশ—
যার ভিতরে ছিল আমাদেরই অতীত।
যার প্রতি কামড়ে আমরা খাইতাম স্মৃতি,
আর গিলতাম নিজেকেই।”
চুখ বুজে আসছিল হটাৎ দুাদুর বাবা তালইকে দেখতে পেলাম সে বলল আরে শশাঙ্করে মাইরা দিল আর আমরা গায়ে রক্ত যখম নিয়া পদ্মা পাড়ে আইছি। লোকজন আসতে লাগলো দলে দলে। আমরা চরে চরে ভইরা গেলাম। এখান থেইকাই ছোট নৌকায় লোকজন পাড়, কত নৌকা ডুবলো, কতজনরে ফেইলা আসতে হইলো। কত গুলালে যে কল্লা নামাই দিল। পদ্মার ইলিশ খুব খুশি। একটা ইলিশকে দাত বের করে হাসতে দেখলাম আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
চরিদিকে বিভাজন, যুদ্ধের প্রস্তুনি নিচ্ছে বিশ্ব, বোমার আঘাতে ইউরোপ চুরমার, মিডলইস্টেও সবজায়গায় বোমা পড়তেছে।
পদ্মার মনে হয় আবার খুশি হওয়ার সময় চোলে আসছে।
