সারসংক্ষেপ (Abstract)
গত পাঁচ বছরে সংঘাত-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো—বিশেষত আফগানিস্তান, সিরিয়া ও মিয়ানমার—একাধিক ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। এই নিবন্ধে ভূমিকম্প পরবর্তী মানব আচরণ, গোষ্ঠীগত মানসিকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘাত-প্রক্রিয়ার পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে মানুষের “attachment surge”, in-group preference, resource anxiety এবং post-traumatic stress কীভাবে সশস্ত্র সংঘাতকে পুনরুজ্জীবিত বা তীব্র করতে পারে—তা তিনটি বাস্তব কেস স্টাডির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, ভূমিকম্প শুধুমাত্র ভূ-প্রাকৃতিক সমস্যা নয়; এটি যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক দুর্বলতার মধ্যকার সমাজে একটি বহুমাত্রিক সংঘাত-প্রবর্তক হিসেবে কাজ করতে পারে।
১. ভূমিকা (Introduction)
সাম্প্রতিক দুর্যোগ মনস্তত্ত্ব ও সংঘাত–অধ্যয়নে একটি উদীয়মান প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে:
“বড় দুর্যোগ কি সংঘাত হ্রাস করে, নাকি উল্টো তীব্র করে?”
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ—বিশেষ করে ভূমিকম্প—মানুষের সামষ্টিক আচরণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। দুর্যোগ মানবজীবনের মৌলিক নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলে, যার ফলে সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া সক্রিয় হয়। যেসব দেশে আগেই যুদ্ধ বা রাজনৈতিক সহিংসতা চলমান, সেখানে এই প্রতিক্রিয়া আরও জটিল হয়ে ওঠে। এই নিবন্ধে এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংঘাতাপন্ন তিনটি দেশে সংঘটিত শক্তিশালী ভূমিকম্পের প্রভাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
২. কেসগুলোর ভূমিকম্প–সংঘাত পটভূমি (Country Cases: Earthquakes in Active Conflict Zones)
২.১ আফগানিস্তান
২০২১–২০২৫ সময়ে আফগানিস্তান পাঁচটি বড় ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়—২০২২ সালের পাকতিকা ভূমিকম্প (মৃ ৬.১), ২০২৩ সালের হেরাত ভূমিকম্পের সিরিজ, এবং ২০২৫ সালের কুনার ভূমিকম্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
হাজারো মৃত্যু
ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষতি
দুর্বল রাষ্ট্র–ব্যবস্থা
তালেবান প্রশাসনের প্রতি অবিশ্বাস
এই সমন্বিত পরিস্থিতি দ্রুত “in-group survival identity” বাড়ায় এবং স্থানীয় মিলিশিয়াদের সক্রিয় করে তোলে।
২.২ সিরিয়া
২০১১ থেকে চলমান গৃহযুদ্ধের মাঝেই ২০২৩ সালে সংঘটিত তুরকি–সিরিয়া মহাভূমিকম্প (মৃ ৭.৮ ও ৭.৭) একটি বিধ্বংসী মানবিক বিপর্যয় তৈরি করে।
বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছায়নি
সহায়তা বণ্টন নিয়ে সন্দেহ ও রাজনৈতিক চাপ বৃদ্ধি
সরকার–বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রণ অঞ্চলে পারস্পরিক দোষারোপ
ফলে দুর্যোগ মানবিক সংকটকে দ্বিগুণ করে এবং সংঘাত-প্রবর্তক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
২.৩ মিয়ানমার
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের ৭.৭ মাত্রার ম্যান্ডালে ভূমিকম্প দেশের বৃহৎ অংশে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে।
বিদ্রোহী অঞ্চল বনাম সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ জটিলতা
যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা
মানবিক সহায়তায় বাধা
“কাকে সাহায্য দেওয়া হচ্ছে, কাকে নয়”—এ নিয়ে তীব্র অবিশ্বাস
এসবই ভূমিকম্প–পরবর্তী সংঘাত বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
৩. দুর্যোগ–পরবর্তী মনস্তত্ত্ব: একটি বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো (Psychosocial Framework After Earthquakes)
দুর্যোগ–পরবর্তী মানবীয় আচরণ বোঝার জন্য নিম্নের মনস্তাত্ত্বিক ধারণাগুলো গুরুত্বপূর্ণ:
৩.১ Attachment Surge — প্রিয় গোষ্ঠীকে আঁকড়ে ধরা
ভূমিকম্প–পরবর্তী সময়ে মানুষ সাধারণত
পরিবার
ধর্ম
জাতিগোষ্ঠী
রাজনৈতিক দল
—এসব পরিচয়ের দিকে আরও বেশি আকৃষ্ট হয়।
এর কারণ হলো জীবনের অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভীতির মাঝে মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তা খোঁজা।
৩.২ In-Group vs Out-Group Dynamics (We vs They effect)
সামাজিক মনোবিজ্ঞানে এটি সুপরিচিত:
সংকট → নিজের গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি
অপর গোষ্ঠীর প্রতি সন্দেহ বৃদ্ধি
এটি সংঘাতগ্রস্ত দেশে আরও বাড়ে, কারণ সেখানকার পরিচয়ভিত্তিক বিভাজন আগেই সক্রিয়।
৩.৩ Resource Anxiety & Survival Competition
দুর্যোগের পর মৌলিক সম্পদ—খাবার, পানি, আশ্রয়—স্বল্প হয়ে যায়।
ফলে দেখা দেয়ঃ
দোষারোপ
সহায়তা বণ্টন নিয়ে অবিশ্বাস
“আমাদের অধিকার ওরা ছিনিয়ে নিচ্ছে” মানসিকতা
এগুলো বড় সংঘাতকে ত্বরান্বিত করে।
৩.৪ Post-Traumatic Stress & Aggression Spike
PTSD, উদ্বেগ, আতঙ্ক, ঘুমহীনতা—এসব মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত
মানুষকে আরও
আবেগপ্রবণ,
প্রতিক্রিয়াশীল,
এবং কখনও কখনও আক্রমণাত্মক
করে তুলতে পারে।
এই আচরণ যুদ্ধক্ষেত্রে সংঘাতকে তাত্ত্বিকভাবে “fuel” হিসেবে কাজ করে।
৪. ভূমিকম্প ও সংঘাতের আন্তঃসম্পর্ক: বিশ্লেষণ (Interplay Between Seismic Disasters and Conflict Escalation)
৪.১ দুর্বল রাষ্ট্র কাঠামোর সুযোগ গ্রহণ
আফগানিস্তান, সিরিয়া ও মিয়ানমারে—
রাষ্ট্র দুর্বল (weak state capacity) থাকায় দুর্যোগ–পরবর্তী শূন্যতা সৃষ্টি হয়।
এই শূন্যতা সাধারণত পূরণ করে:
স্থানীয় মিলিশিয়া
সশস্ত্র গোষ্ঠী
ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ
প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তি
ফলে সংঘাত-পরিস্থিতি নতুন মাত্রা পায়।
৪.২ সহায়তা–রাজনীতি (Politics of Aid)
দুর্যোগ–পরবর্তী সহায়তার প্রবাহ প্রায় সবসময় রাজনৈতিক।
যেসব দেশে বহুগোষ্ঠী সংঘর্ষ চলছে, সেসব স্থানে সহায়তার দিকনির্দেশনা “পক্ষপাত” হিসেবে দেখা হয়।
ফলাফল:
অবিশ্বাস
গোষ্ঠীভিত্তিক রাগ
সহিংসতা
রাষ্ট্রের প্রতি শত্রুতা বৃদ্ধি
৪.৩ আঘাতপ্রাপ্ত পরিচয় (Traumatized Identity) ও বিদ্যমান বৈরিতা
দুর্যোগ মানুষের ব্যক্তিগত পরিচয়কে আঘাত করে; যুদ্ধ আবার সামষ্টিক পরিচয়কে আঘাত করে।
যখন দুটো একসাথে ঘটে, তখন সমাজে জন্ম নেয় এক ধরনের collective trauma
যা আরও বড় সংঘাতকে প্ররোচিত করতে পারে।
৫. আলোচনাঃ কেন দুর্যোগ–পরবর্তী সংঘাত কিছু দেশে বাড়ে, কিছু দেশে নয়?
উন্নত বা শান্ত দেশগুলিতে বড় দুর্যোগ সাধারণত জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে।
কিন্তু সংঘাতপূর্ণ দেশে ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটে।
এর কারণ তিনটি:
1. রাষ্ট্র দুর্বল – তারা সুশৃঙ্খল সহায়তা দিতে পারে না।
2. পরিচয়ভিত্তিক বিভাজন আগেই অস্তিত্বশীল – দুর্যোগ সেই বিভাজনকে আরও খোলা করে।
3. অস্ত্র এবং সংগঠিত গোষ্ঠী সক্রিয় থাকে – তারা দ্রুত পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক সুবিধায় রূপান্তর করে।
এই তিন উপাদান মিলেই ভূমিকম্প–পরবর্তী সংঘাত বৃদ্ধি পায়।
৬. উপসংহার (Conclusion)
ভূমিকম্প শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; এটি রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামোকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়। আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং মিয়ানমারের অভিজ্ঞতা দেখায় যে দুর্যোগ–উত্তর মানসিক প্রতিক্রিয়া, রাষ্ট্রের দুর্বলতা এবং পরিচয়ভিত্তিক বিভাজন একত্রে বৃহত্তর সংঘাতকে পুনর্গঠন বা তীব্র করতে সক্ষম।
অতএব, সংঘাতপূর্ণ দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেবল ত্রাণ বা পুনর্গঠন নয়—
এটি মনস্তত্ত্ব–সমাজতত্ত্ব–রাজনীতিবিজ্ঞান সমন্বিত একটি পূর্ণাঙ্গ রূপান্তরমূলক প্রক্রিয়া।
এই নিবন্ধের বিশ্লেষণ দুর্যোগ–পরবর্তী নীতি, আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা এবং সংঘাত রোধে একটি কার্যকর তাত্ত্বিক কাঠামো প্রদান করতে সক্ষম।
